
নিউ ইয়র্কে ঘটে যাওয়া ৯/১১ এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এফবিআই বারশত বিদেশী বংশোদ্ভূত নাগরিককে অবৈধভাবে হরণ করে, নির্বাসনে পাঠায় আর প্রায় তিন বছর ধরে অমানবিক নির্যাতন করে।সরকার তাদের কারোরই কোন যোগসূত্র খুঁজে পায়নি এই ঘটনার সাথে। এমনকি তাদের মধ্য থেকে এক হাজার জনের বেশি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীরা ফিরে আসতে পারেনি তাদের স্বাভাবিক জীবনে। জুন ২০০৬, জর্জ বুশ বলেন যে- আমি অত্যাচারের নির্দেশ কখনও দেইনি, আমি কখনই অত্যাচারের নির্দেশ দেব না।এই দেশের মূল্যবোধ এমন যে- অত্যাচার আমাদের আত্মা ও অস্তিত্বের অংশ নয়। ২২ শে জানুয়ারী ২০০৯, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির আসনে উপবিষ্ট হবার দুই দিন পরই বারাক ওবামা অত্যাচার ও নির্বাসনের কুখ্যাত প্রতীক গুয়ান্টানামো কারাগার বন্ধের নির্দেশ দেন।
এই ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি “নিউইয়র্ক” এর পটভূমি। কাহিনীতে যাবার আগে কারিগরি দিক নিয়ে কিছু আলোচনা করি। ছায়াছবির চিত্রাধারণ আমার কাছে খুবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মনে হয়েছে। চিত্র ধারণ এমনভাবে নেওয়া হয়েছে যা দর্শনের পরে চোখকে বিনোদন দেয়। সম্পাদনাও ভাল হয়েছে। হিন্দি ছায়াছবির মত এই ছবিতেই গান ছিল তবে পার্থক্য এই গানগুলোকে নেপথ্যে ব্যবহার করে ছায়াছবির বাস্তব ভাবমূর্তিকে বলবৎ করা হয়েছে। ছায়াছবির পরিচালক কবির খান পরিচালনার দক্ষতায় সফল বলতে হবে। আদিত্য চোপড়া আর ইয়শ চোপড়ার প্রযোজনায় একটি ব্যবসা সফল ছায়াছবি। ছায়াছবির কাহিনী লেখেছেন সন্দীপ শ্রীবাস্তব। ছায়াছবির প্রথম দিকে ক্যাটরিনাকে একটু বেশি উচ্ছল তরুণী মনে হয়েছে যা ভাল লাগেনি। তবে পরবর্তীতে বিবাহিতা এবং মায়ের চরিত্রে তাকে খুব ভাল লেগেছে। জন আব্রাহাম ও নীলের অভিনয় ভাল লেগেছে। ভাল লেগেছে ইংরেজীর উচ্চারণ নিয়ে মার্কিন অফিসার আর ইরফান খানের সংলাপ। সব গানই ভাল।“তু নে জো না কাহা”- গানটি সব থেকে ভাল লেগেছিল। চলুন- এবার কাহিনীর পথে যাই।
সমীর(জন আব্রাহাম) একজন মুসলমান, ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক কিন্তু মনেপ্রাণে আমেরিকান। তেমনি মায়া(ক্যাট্রিনা কাইফ)- সামীরের সহপাঠিনী। তাদের সাথে যোগ দেয় সদ্য ভারত থেকে পড়তে যাওয়া আরেকজন- ওমর(নীল নিতিন মুখেশ)। তারা নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছায়াছবি শুরু হয়- এফবিআই এর একটি অপারেশন দৃশ্যের মাধ্যমে। রাস্তায় একটি ট্যাক্সিকে পাকড়াও করে তারা। গাড়ীতে পাওয়া যায় অবৈধ অস্ত্র। গাড়ির মালিক ওমরকে এর রেশ ধরে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় এফবিআই ইন্টারোগেশন সেলে।জিজ্ঞাসাবাদে ওমর তার শুরুর দিকে দিনগুলীর কথা বলে যায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত অফিসার রোশনের(ইরফান খান) কাছে। ফ্ল্যাশ ব্যাক করে নিয়ে যাওয়া হয় ওমরের ভার্সিটির প্রথম দিনের সকালে। সেখানে পরিচয় হয় মায়ার সাথে, সমীর সাথে। সে দুর্বল হয়ে পড়ে মায়ার প্রতি। কিন্তু একসময় প্রকাশ পায়- মায়া সামীরকে ভালবাসে। এই অপ্রত্যাশিত শক সে সহ্য করতে পারেনি। সেই সময়ে ঘটে ৯/১১ হামলা। আর সেই সময়েই শহর ছেড়ে চলে যায় ওমর।
সমীর এসাইনমেন্টের জন্য টুইন টাওয়ারের বিভিন্ন এংগ্যালের ছবি তুলেছিল। তার প্রফেসরই তাকে এই কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই অপরাধে সন্দেহের বশে গ্রেফতার হয় সমীর। তাকে নিয়ে যাওয়া চোখ-মুখ বেঁধে। শুরু হয় অত্যাচার। নগ্ন করে রেখে দেওয়া হত। গলায় কুকুরের মত বেল্ট বেঁধে কুকুরের মত থাকতে দেওয়া হত। হাত উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হত। মুখে কাপড় বেঁধে তার উপর প্রস্রাব করে টয়ল্যাটে ফেলে রাখা হত। এমনই বর্বর ছিল সে অত্যাচার। প্রাকৃতিক কাজ সারতে দেওয়া হত না- চাপ আসে তো কাপড়-চোপড়ে করে নিতে বাধ্য করত। গালি দিত- তোর মা বেশ্যা, তোর বোন বেশ্যা। (এই কাহিনী সাইড পটে আরেকজন বন্দীর জবানীতেও এসেছে।) একদিন পাশের সেলের এক বন্দী ধীরে ধীরে বলে- বেরিয়ে দিয়ে যদি নিজের অপমানের বদলা নিতে চাও তো যোগাযোগ কর। একসময় সমীর মুক্তি পায়। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে সে ফিরতে পারে না। মায়া তখন তার পাশে দাঁড়ায়- বিয়ে করে তারা। তাদের সংসার হয়। আর ওদিকে সমীর জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে- নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে। এই খবর চলে যায় এফবিআইয়ের কাছে কিন্তু কোন প্রমান নেই। তাই তারা নাটক সাজিয়ে গ্রেফতার করে ওমরকে।
ওমরের কাছে প্রকাশ হয়ে যায় এফবিআইয়ের নাটক। তারা স্বীকার করে এবং তাদেরকে সাহায্যের জন্য হুমকি দেয়। একসময় বন্ধুকে সাহায্য করার কথা ভেবে ওমর রাজি হয়। এভাবেই সাজানো নাটকে সে ফিরে যায় সমীর ও মায়ার কাছে। চলতে থাকে নাটকের অভিনয়- সমীরের পরিকল্পনা বের করার জন্য। একসময় ওমর সফল হয়। ওমরের উদ্দেশ্য মায়াও জানতে পারে। সমীরকে প্রাণে মারা হবে না এই ওয়াদায় সমীরকে ফিরিয়ে আনতে এবং পরিকল্পনা থেকে দূরে সরাতে মায়া রাজি হয়। সমীর তখন এফবিআই সদর দপ্তরে হামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে। মায়াও সেই সময়ে সদর দপ্তরে এফবিআইয়ের ওয়াদার কাগজ নিতে। কিন্তু ওমরের কাছে তখন ধরা পড়ে সমীর হামলা করবে। বন্ধুকে এই কাজ থেকে বিরত রাখতে আর ভয়াবহ হামলা থেকে বাঁচাতে সে জানিয়ে দেয় রোশনকে। মূহুর্তেই চারিদিক থেকে নিরাপত্তাকর্মীরা ঘিরে ফেলে। ওমর তখন ছুটে যায়- সমীরের কাছে।সব কথা তাকে খুলে বলে । তাকে ফিরে আসতে বলে। মায়াও সেখানে চলে আসে। চলে আসে রোশন। ওদিকে হেলিকপ্টারে করে পজিশন নেয় আরও স্ন্যাইপার। সাথে এফবিআইয়ের প্রধান অফিসার। সমীরকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেও শেষ রক্ষা হয় না। রোশনের মানা সত্ত্বেও প্রধান অফিসারের হুকুমে গুলির মুখে মারা যায় সমীর, মারা যায় মায়া।
……………..এই হলো মূল কাহিনী। আরও কিছু সাইড পটে বন্দীদের অত্যাচার আর সেই অত্যাচারের প্রভাব ফুটে উঠেছে। ছায়াছবিতে ফুটে উঠেছে- নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, বিচার বহীর্ভূত নির্বাসন- ঘৃণারই জন্ম দিয়েছে। সমীরের মত সাদা মনের মানুষকে জঙ্গী হতে বাধ্য করেছে। একজন জঙ্গী হলে তো সকল জঙ্গী হয়ে যায় না। কিন্তু এফবিআইয়ের ভুল নীতি সমীরের মত মনে-প্রাণে আমেরিকানকে বিপথে ঠেলে দিয়েছে।রোশন আর ওমরের কথোপকথনে কিছু বিশেষ দিক উঠে এসেছে। ওমর রোশনকে বলেছিল- আপনারাই বানিয়েছেন সমীরকে সন্ত্রাসী। নির্বাসনে থাকার পরে একজন মানুষ আর তার পূর্নের অবস্থায় যেতে পারে না। তখন রোশন বলেছিল- অত্যাচারের বদলা নিয়ে সন্তাসী হওয়া তো বিচার হতে পারে না। তুমি আর আমি মুসলমান। ইসলাম শান্তির ধর্ম, বাস্তবেও যা কিছু শান্তির পক্ষে সেখানে ইসলাম। হ্যাঁ এই দেশ(আমেরিকা) অনেক ভুল করেছে। আমাদেরকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু এই দেশের অনেক ভাল দিক আছে যা আমাদের ভুললে চলবে না। আমি এক মুসলমান- মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এই স্পর্শকাতর মামলা আমার কাছে সঁপা হয়েছে।একমাত্র এই দেশে তা সম্ভব। একথা ভুলে যেওনা তুমি আর আমি এখানে অভিবাসী হয়ে এসেছিলাম- এখানে আপনাদের জায়গা হয়েছিল, নিজেদের স্বাধীনতা পেয়েছিলাম আমরা।সেই স্বাধীনতাকেই বাঁচাতে আজ আমি এসব করছি। মুসলমান্দের বিপক্ষে যে ঘৃণা এই দেশে বা অন্য দেশে জন্ম নিচ্ছে তাকে সম্মানে বদলে নেবার কাজ আমাদের মুসলমানকেই করতে হবে। ..................
শেষ অংশে ওমর আর রোশনের সংলাপও গুরুত্ববহন করে। সমীর আর মায়ার ছেলে প্রতিযোগীতায় খেলছিল। রোশনকে দেখা করতে আসে। কথাপ্রসঙ্গে রোশন ওমরকে বললো- তুমি আর আমি সমীরকে মারিনি। সমীর যে পথে বেছে নিয়েছিল তাই তাকে মেরেছে। ওমর জবা দিলো-“ কিন্তু মায়া? তার কি দোষ ছিল?” দোষ কারোরই ছিল না- সবাই সবার জায়গায় ঠিক ছিল। শুধু সময়টাই ছিল খারাপ। খারাপ সময়ে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, দেশ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়- তাই হয়েছে। ওমর আবার জিজ্ঞেস করে- “কি মিললো আমায় আপনার এই অপারেশনে? আমার দুই বন্ধুর মৃত্যু আর আপনার জন্য একটি মেডেল। কি প্রাপ্তি হলো? যেদিন আপনার কাছে এর জবাব মিলবে সেদিন কথা বলবো”। রোশন বললো- “জবাব তো তোমার সামনেই।এক আমেরিকান দলে মুসলমান বাচ্চা খেলছে যার বাবা ছিল সন্ত্রাসী। আর ঐ ছেলেকেই এরা কাঁধের উপরে হিরোর মত তুলে রেখেছে।আমরা এটুকুই পেয়েছি। এই আমাদের প্রাপ্তি।
ছায়াছবিটি শিক্ষামূলক- আমেরিকানদের জন্য আর মুসলমান্দের জন্যও। যে মেসেজ ছায়াছবিটি দিতে চেয়েছে তা দিতে সফল হয়েছে- এই ছায়াছবির সফলতাই তাই বলে।
"
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন