বাংলাদেশের অর্জন উৎসর্গ স্ট্রীট ম্যাপ: "মিথ বাস্টার নামে আবলামি চলতেছে ব্লগে- ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলা, পাকিস্তানী শাসনামলে পূর্ব বাংলা এবং ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন এক আবাল পাব্লিক। সেখানে তিনি বিভিন্ন উপাত্ত দিয়ে উৎপাত করে প্রমাণ করতে চাইছেন আদতে ৭১ এ বাংলাদেশ হওয়ার পরে এই দেশের মুসলিম নাগরিকদের তেমন উন্নয়ন হয় নি। বিষয়টা বেশ বিরক্তিকর এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমার জন্য অবমাননাকর।
পাকিস্তানে এখনও বেশ কিছু বাঙ্গালী আটকা পড়ে আছেন, যারা স্বদেশে ফিরে আসবার পূঁজি জমাতে পারেন নি বলেই সেখানে রয়েছেন , এইসব বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশীদের বাইরে যারা পাকিস্তানে আদর্শিক কারণে হিজরত করেছেন কিংবা পিঠের চামড়া বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন, তাদের সবারই উর্দুপ্রীতি প্রবল এবং তারা বাংলা ভাষায় লিখতে এবং পড়তে পারে না। যারা আদর্শিক কারণে পাকিস্তানে বসতি স্থাপন করেছেন তারা বাংলা ভাষাভাষি হলেও তাদের বাংলাদেশী ভাববার কোনো কারণ নেই এমন কি তারা যদি নিজেকে বাংলাদেশী ভাবেই সেটা আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর।
পিঠের চামড়া বাঁচাতে অনেকেই যুদ্ধাপরাধী হয়ে এই দেশ গণহত্যা করে ফেরার হয়েছেন বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে নির্ধারিত শাস্তি এড়ানোর জন্য, তাদের সন্তান-সন্ততিরা যদি পিতার অপরাধ স্বীকার করে লজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের সংবিধানকে সম্মান করে তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে আমার সমস্যা নেই। মূলত সংবিধানের প্রথমেই উল্লেখিত আছে ২৫শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো এবং যারা এই যুদ্ধকে স্বাধীনতা যুদ্ধ মনে করে এবং মুজিবনগর সরকারের আদর্শকে ধারণ করে তারা বাংলাদেশী পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে। এবং তাদের জন্যই এই সংবিধান এবং এই সংবিধানের ভিত্তিতে রচিত সকল আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য।
এইটুকু পূর্বালোচনা করা প্রয়োজন, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাংলাদেশী মানুষদের অর্জন, এটা দাক্ষিন্যে প্রাপ্ত কোনো কিছু নয়, আমরা যারা বাংলাদেশী নাগরিক, তারা এবং তাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজের রক্ত দিয়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছেন। এবং এই একটা মানচিত্র এবং এর সাথে সম্পর্কিত সকল কিছুর জন্য লড়াই করেছেন ৭১ এ।
যারা এখনও পাকিস্তান প্রেমে মগ্ন তাদের এই দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং আমার ধারণা এই যে দাক্ষিণ্যের উপলব্ধি কিংবা পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশ ভালো ছিলো, বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী ভালো ছিলো- এমন উপলব্ধি সরাসরি আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
এটা সত্য যে আমাদের যেখানে পৌঁছানোর ছিলো, আমাদের পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব, নিজস্ব লোভ-লালসা এবং সংকীর্ণতার জন্য আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারি নি, তবে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে লক্ষণীয় ভাবেই, অন্তত পরিসংখ্যান ঘেঁটে ৭১ পূর্ববর্তী পশ্চিম পাকিস্তান এবং ৭১ পরবর্তী পাকিস্তানের অর্জন এবং বৈশ্বিক অবদান বিবেচনা করে এবং ৭১ পূর্ববর্তী পূর্ব বাংলা এবং ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্জনগুলো পরিসংখ্যানে মাপলে এটুকু নিশ্চিত হওয়া যাবে পূর্ব বাংলার বঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠী ৭১ পূর্ববর্তী সময় থেকে বর্তমানে অনেক বেশী স্বাধীনতা, সম্মান এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার চর্চা করতে পারছে।
---------------------------------------------------------------------------------
ঐতিহাসিক সত্য হলো ১৯৩৭ এর নির্বাচনে মুসলীম লীগের ভরাডুবি হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে এবং মুসলিম লীগ যে এরপরও একটা প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন হয়েছিলো অবিভক্ত ভারতে সেটার মূল অবদান অবিভক্ত বাংলার মুসলিম জনসাধারণের। তারাই নিজস্ব রাজনৈতিক লড়াই এবং আদর্শিক লড়াইয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে জন্ম দিয়েছিলো। ১৯৪০ এ লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো, সেটা ছিলো মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভড়াডুবির পর্যালোচনা শেষে মুসলীম লীগের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রস্তাব, যা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে স্বীকৃত হয়েছে, তাদের সমর্থন দেওয়ার ফলে এই উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠি কি কি বাড়তি সুবিধা পাবে, কি কি বৈষম্যের অবসান ঘটবে, এবং এটাও সত্য জিন্নাহ সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের তুলনায় সামান্য বাড়তি সুবিধা চেয়েছিলো মুসলিমদের জন্য- এবং সেটুকু নিশ্চিত হলে আদতে আমাদের এত আলোচনা বাদানুবাদের প্রয়োজন ছিলো না। এটা তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিজস্ব দ্বন্দ্ব, স্বার্থ এবং লোভের পরিণাম যে ভারত বিভাজিত হয়েছে।
১৯৪০ এ লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো
Resolved that it is the considered view of this Session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to the Muslims unless it is designed on the following basic principles, viz., that geographically contiguous units’ are demarcated into regions which should be constituted, with such territorial readjustments as may be necessary that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the North Western and Eastern Zones of (British) India should be grouped to constitute Independent States in which the constituent units should be autonomous and sovereign.
That adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for minorities in these units in the regions for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultations with them and in other parts of (British) India where the Mussalmans (Muslims) are in a majority adequate, effective and mandatory safeguards shall be specifically provided in constitution for them and other minorities for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.
চৌধুরী খালেকুজ্জামান ১৯৪২ সালের ৭ই অক্টোবর জিন্নাহকে পাকিস্তান প্রস্তাবের ভিত্তিতে লিখেছেন
One of the basic principles lying behind the Pakistan idea is that of keeping hostages in Muslim Provinces as against the Muslims in Hindu Provinces. If we allow millions of Hindus to go out of our orbit of influence, the security of the Muslims in minority Provinces will greatly be minimised
তার এই আশংকা মিথ্যা হয় নি,
অন্তত দুটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা ছিলো, যারা স্বায়ত্বশাসিত হবে- এই প্রস্তাবনার পক্ষে রাজনৈতিক লড়াই করেছে পূর্ব বাংলার মুসলিমেরা।
তবে পূর্ব বাংলা স্বায়ত্ব শাসন পায় নি, পায় নি নিজস্ব শাসনব্যবস্থা এবং মূলত ভাতৃত্বের বানী দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান এই দেশকে তাদের উপনিবেশ বানিয়ে তুলেছিলো। সুতরাং যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র পূর্ব বাংলা হলেও মোট দেশজ উৎপাদনের সিংহভাগ খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, বঞ্চনা এবং অত্যাচার ছিলো পূর্ব বাংলার মুসলিমদের নিত্যদিনের প্রাপ্তির খাতায়। এবং এভাবেই এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন কিংবা অপশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে এবং সেটা শেষ পর্যন্ত লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে গিয়ে স্বাধীকারের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং উৎপাদন ও বন্টনের পূর্ন স্বাধীনতা অর্জন করেছে, এবং যদিও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তারা এখনও তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি বুঝে নিতে পারে নি, তবুও তারা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ের উন্নতি হয়েছে পাকিস্তানের তুলনায় বেশী, এবং কালে কালে পাকিস্তান আদর্শশূন্য একটি ফ্যাসাদ এবং বৈশ্বিক উৎপাতে পরিনত হয়েছে।
স্বাধীনতার পরে আমাদের অর্জন এবং অগ্রগতি যদি সম্মুখপানে হয় তবে পাকিস্তান যাত্রা করেছে বিপরীত পথে এবং প্রতিদিন আরও বেশী বর্বর রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে সেটা।
উল্লেখযোগ্য অর্জনের তুলনা করা যাক-
পাকিস্তানের ঋণের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৩০ গুণ বেশী, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন ডলার।
আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় বেড়েছে ৬ গুন, পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় বেড়েছে ৪ গুণ।
পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এত কম যে এ বছরই তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পায়ে ধরেছে এবং যদিও বাংলাদেশ সরকারকে স্পষ্টতই নিয়ন্ত্রন করছে কতিপয় বৈদেশিক রাষ্ট্র, তবে পাকিস্তানের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের করদ রাজ্য হয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে নিজের ধান্দায়, এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বছর বিশাল অঙ্কের দেনা মওকুফ করেছে, এই ঋণ মওকুফের বদৌলতে তারা পাকিস্তানের নাগরিকদের নির্বিচারে বোমা মেরে খুন করছে এবং পাকিস্তানের সকল মানুষ সেটা নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছে-
সেখানে দেনার দায়ে মানুষ পরিবার বেচে দিচ্ছে মহাজনের কাছে, মহাজন এইসব আধুনিক দাসদের নিজেদের ইচ্ছামতো কাজে নিয়োজিত করছে, তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল-
আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি নি সত্য- আমাদের প্রচুর বৈদেশিক সহায়তা আসছে, এনজিও দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় এটাও একটা দুঃখজনক বাস্তবতা, আমাদের মোট প্রাপ্ত অনুদানের মাত্র ৫ % প্রকৃত উন্নয়নে ব্যয় হয়, বাকি সবটুকুই বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নিজস্ব বিলাসে ব্যয় হয়ে যায়, এই মাথাভারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক আমাদের সম্মানিত এবং পরিচিত সুশীলেরা, যারা লুঙ্গি খুলে গেলেও মিছিল মিটিং করেন, সেই বীর পুঙ্গব নিজেও এনজিওবাজ, তার স্ত্রীও এনজিও বাজ এবং গতকাল কালো শাড়ী পড়ে ফরিদা আপার অনুগত মেয়েরা পুনরায় লুঙ্গি বিষয়ে সমাবেশ করেছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ উন্নয়ন ভাবনা এবং উন্নয়ন ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে বিছানায়, কে কার সাথে বিছানায় গিয়ে কোন উন্নয়ন ব্যয়ের বরাদ্দ নিয়ে আসে এইসব নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো, অনেকের পেটেই অনেক কেচ্ছা লুকিয়ে আছে। তবে এইসব তথাকথিত সুশীলে বিছানাবিপ্লব, সঙ্গমকালীন সময়বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত সঙ্গমক্লান্ত উন্নয়ন ভাবনাগুলো কোনোভাবেই সঠিক ভাবে ব্যবহৃত হয় নি, তাদের নিজস্ব লোভ লালসা তাদের শরীরে মেদের পরিমাণ বাড়িয়েছে- এবং তারা খতিপয় শব্দ দিয়ে নিজের পকেট ভারি করছেন- এইসব সভ্য লুণ্ঠনের পরেও আমাদের জিডিপি এবং আমাদের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। আমরা সামনে যাচ্ছি, যদিও অনেক বঞ্চনা এখনও বিদ্যমান তবে আমাদের অগ্রগতি সামনের দিকেই-
পাকিস্তানের অগ্রগতির হার নিম্নমুখী, ব্যপক অনুদান এবং সহায়তা দিয়েও এই ভরাডুবি ঠেকাতে পারে নি তারা। এবং ৭১ পূর্ববর্তী সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বর্তমান পাকিস্তানের তুলনা করলে অন্তত এইটুকু স্পষ্ট হবে, তাদের উত্থানের পেছনে ছিলো পূর্ব বাংলার ঔপনিবেশিক শোষণ, এবং সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তাদের লক্ষ্যনীয় উন্নয়ন না হলেও আমাদের অর্জন বেড়েছে।
এইটুকুই আমাদের স্বাধীনতার অর্জন-
আমাদের বিসিএসের ৯০ শতাংশ ক্যাডার মুসলিম- যেখানে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে ২৩ বছর মাত্র ২০ শতাংশ বাঙালী মুসলিম ছিলো
আমাদের ব্যয়বরাদ্দ এবং ব্যয় সংস্থানের জন্য আমাদের অন্তত অন্য কোনো দেশের দিকে তাকাতে হয় না।
"
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন