বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০০৯

একজন মনির আলী

একজন মনির আলী: "null

খুব সকালে উঠে ছাঁই দিয়ে দাঁত মাঁজে মনির আলী

অথবা পানি দিয়ে কুলি করে নেয়।

হালের বলদ দুটিকে নিয়ে মাঠে ছুটে-

সারা বছরের খানাপিনা তো ওই জমিগুলো থেকেই আসে।

এখন সে একা না- তার কুঁড়ে ঘরের কালো মানিক তিনজন আছে।

সবাই মিলে যুবতী মাটির কুমারীত্ব কেড়ে নেয় লাঙ্গলের ফলায়;

আর সেই মাটি বুক মেলে দেয় সোনা।



চৌধুরী সাহেবের কুনজর যখন পড়েছিল মনির আলীর যুবতী বউয়ের উপর-

সে জেনেছিল বা জানেনি,

হয়তো সেদিকে দৃষ্টি দেয়নি বা মেনে নিয়েছিল;

কারণ আশ্রয়দাতা রুষ্ট হলে নিরাশ্রয় হতে হবে-

তখন দীন-দুনিয়ার মালিককে ডেকেও লাভ হবে না।

নদী ভাঙ্গনে জমি হারিয়ে গেলে এই চৌধুরী সাহেবই আশ্রয় দিয়েছেন।

তার অগোচরে চৌধুরী সাহেব তারই শয্যার দখল নিলেও কিছু বলেনি সে;

কিছু বলেনি সর্বংসহা সে নারী।

গরীবের ইজ্জত বলে কিছু থাকতে নেই-

থাকলেই যত বিপদ আর চুপ করে থাকলেই লাভে লাভ।

চৌধুরীর বীজ মনির আলীর কুঁড়ে ঘরের কালো মানিকের মাঝে

এক চান্দের আলো সোনার ঠুকরী নিয়ে এলে মনির আলী তাকে পিতৃ স্নেহ দিয়েছ।

শীতের সকালে বুকের উম দিয়ে আদরে যত্নে বড় করেছে-

তাই আজ যখন দূর্ঘটনায় পতিত সেই চান্দমুখ ছেলে দূর্ভাগ্যের দিনগুণে,

মনির আলী ডুকরে ডুকরে কাঁদে।



চৌধুরী সাহেবের নজরের ভয়ে সকল পিতা বাড়ন্ত মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত থাকত-

কতজন যে দূরে কোথাও চলে গেছে;

মনির আলী এসব ভাবে না।

চৌধুরী সাহেবে যখন অঝোরে কাঁদছিলেন উনার প্রথমা স্ত্রী মারা যাওয়ায়-

মনির আলী পাশেই ছিল।

সে ভাবেনি চৌধুরীর বুকে ভালবাসার মাজেজা কি?

চির অনুগত দাসের মত সে আজও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে যায়-

ভুলেনি নিরাশ্রয়ের আশ্রয় আজ এতদিন পরেও;

চৌধুরীর জমানা তো কবেই গত হয়ে গেছে।



ঠাকুর বাড়ির কিছু দুফসলী জমি চাষ দিয়ে চলে তার বছর।

তার বাপও সারা জীবন এভাবেই কাটিয়েছে-

সেই কাটাচ্ছে আর তার কালো মানিকরাও সেই কাজ করে- করবে।

বড় বিশ্বস্থ সে- কোন দিন তার মুখে না শব্দ আসেনি,

যখনই ডাক পড়ে সে আসে-

তার ছেলেরাও আসবে।

একটু আদর করে ডেকে নিয়ে মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খেতে দিলে

তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে।

কত অল্পতে খুশী হয় বাংলার মনির আলীরা!



পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে কি না সে নিজেই জানে না-

শুক্রবার হলে জুম্মার নামাযে তকি মাথায় দিয়ে মসজিদে যায়,

ইমাম সাহেবের বয়ান শুনে,

হাত তুলে মোনাযাত করে।

রমযান মাসে রোযা রাখে বা রাখে না-

তবু ঈদ এলে নিজে পরুক আর না পরুক

তার কালো মানিকদের গায়ে এক থান করে হলেও নয়া কাপড় দেয়।

শাহী ঈদগাহে ঈদের নামায শেষে কুলাকুলি করে-

কারও বাড়িতে দাওয়াত পেলে অন্তর হতে দোয়া করে।

ঠাকুর বাড়ির পূজার প্রসাদও সে ভক্তি ভরে নেয়-

খিচুড়ী আর মিষ্টান্ন দিয়ে ধীরে ধীরে খেয়ে যায়।

বাংলার মনির আলীরা চির অসাম্প্রদায়িক হয়!



দেশ কার হাতে চলছে-

সংসদে কি মাছের বাজার বসেছে?

এসব ভাবে না মনির আলী।

বাজার গরম হলেই তার বুক ধকধক করে উঠে।

নির্বাচন এলে হয় ধানের শীষ না হয় নৌকায় সিল মারে-

তাও নিজের ইচ্ছায় নয়;

কেউ এক কাপ চা খাইয়ে পক্যাটে একশো টাকা গুজে দিলে

ভোটটা সেখানেই দিয়ে আসে।

বাংলার গণতন্ত্র আর প্রজাতন্ত্র!



দু'বেলা দুমুঠো ভাত লবন-মরিচ আর শুটকি দিয়ে খেলেও খুশী সে,

রোগে একটু চিকিৎসা চায়।

কারও ধন, কারও টাকায় লোভ নাই তার-

নিজে ফলায় নিজে খায়- কারও করুণায় নয়;

সে বরঞ্চ করুনা করে যায়।

একজন মনির আলী- এ মাটিরই সন্তান;

তার সহিষ্ণু দর্শন- উদার মনন-

হারামজাদা বুদ্ধিজীবিদের কলমের কালিতে লেখা হয় না।

মনির আলীর শাস্ত্র মনির আলী নিজেই লেখে যুবতী মাটির বুকে।

এভাবেই মনির আলীরা বেঁচে থাকে বাংলার ছায়াঘেরা শ্যামল গ্রামের মায়া ঘিরে।"

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন